কর্নেল ইব্রাহিম ফারুক, বিজিবিএম–
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্ম হয়েছিল স্বাধীনতাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চালিকাশক্তি ছিল তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি অফিসার ও সৈনিকরা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সেনা সদস্যরা নানাভাবে বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হন, যার ফলে স্বাধীনতার এই সূচনালগ্নে তাঁরা আর বসে না থেকে এ দেশে পালিয়ে আসেন, আর মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেন। এই সামরিক অফিসার ও সৈনিকরা ১১টি সেক্টরে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধের কমান্ড পর্যায়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন আর এভাবেই সূচনা হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর।
রণক্ষেত্রে জন্ম নেওয়া একটি সেনাবাহিনী অনেক চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে আজ অনেক দক্ষ, সুসংগঠিত এবং দেশে-বিদেশে প্রশংসিত। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডের অখণ্ডতা রক্ষার পাশাপাশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্বপরিমণ্ডলে আজ একটি পরিচিত এবং গর্বিত নাম। এ ছাড়া দেশের এবং জনগণের সব ধরনের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহায়তায় এগিয়ে আসতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সাংবিধানিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
দেশের যেকোনো ক্রান্তিকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের প্রয়োজনে সব সময়ই জনগণের আস্থার প্রতীক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে এসেছে।
এমনকি ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যখন দেশব্যাপী বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, পুলিশসহ বেশির ভাগ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী অকার্যকর ছিল, তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সারা দেশে মোতায়েন থেকে জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা বিধান করে দেশে-বিদেশে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছে। দুর্গাপূজাসহ সব সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উত্সবে সেনাবাহিনীর অক্লান্ত পরিশ্রম ও তত্পরতার কারণে অত্যন্ত সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এখনো সেনাবাহিনীর সদস্যরা সারা দেশে নিয়োজিত আছেন এবং একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে দেশের জনগণের আস্থার প্রতীক হয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে অবকাঠামোগত উন্নয়নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের সরকারের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে আসছে, যা দেশ তথা সমগ্র জাতির জন্য কল্যাণকর।
তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘যমুনা সেতু’ নির্মাণে সার্বিক দায়িত্ব পালন, দেশের মেগাপ্রজেক্ট খ্যাত ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু’র রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন, হাতিরঝিল প্রজেক্ট, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্রে নিরাপত্তা, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত পাইপলাইনে জ্বালানি তেল পরিবহন, টুঙ্গিপাড়ায় বিটিসিএল ওয়াইফাই প্রকল্প, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, অসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা, আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, এফডিএমএন সংকট ব্যবস্থাপনা, স্বয়ংক্রিয় বর্ডার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, ই-পাসপোর্ট, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি সম্প্রীতি উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান, চিকিত্সা ক্ষেত্রে অবদান, জাতীয় উন্নতিতে অবদান, কভিড-১৯ ইত্যাদি।
দেশের সর্বপ্রথম বৃহত্তম সেতু যমুনা বহুমুখী সেতু। ১৯৯৪ সালে প্রথম যমুনা সেতুর কাজ শুরু হয় এবং ১৯৯৮ সালে সেতুটি যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। যমুনা সেতু নির্মাণের সময়ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এবং নির্মাণের পর থেকে এখন পর্যন্ত সেতুর সার্বিক তত্ত্বাবধায়ন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিরাপত্তার সার্বিক দায়িত্ব বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে আসছে। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের মেগাপ্রজেক্টগুলোর মধ্যে অন্যতম, যা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পর্যবেক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে।
হাতিরঝিল রাজধানী ঢাকার মানুষের চলাচলের জন্য ২০১৩ সালে তৈরি করা হয়। মূলত ঢাকায় বসবাসরত বিভিন্ন এলাকার জনগণের বিশেষ সুবিধার জন্য হাতিরঝিল প্রজেক্ট চালু করা হয়। এ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, জলাবদ্ধতা ও বন্যা প্রতিরোধ, ময়লা পানি নিষ্কাশনব্যবস্থার উন্নয়ন, রাজধানীর যানজট নিরসন এবং সৌন্দর্য বর্ধন। রাজধানীতে বসবাস করা মানুষের কথা মাথায় রেখে হাতিরঝিল প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এই প্রকল্পের নির্মাণ, তদারকি এবং বাস্তবায়নসহ সার্বিক দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ‘স্পেশাল ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন’-এর ওপর। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের ৯৭১ কোটি টাকার হাতিরঝিল প্রজেক্ট স্বল্প সময়ে অত্যন্ত সুন্দরভাবে সম্পন্ন করে। সেনাবাহিনীর এই প্রজেক্টের (হাতিরঝিল) কাজের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন (এডরা) পরিসর পরিকল্পনা ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশকে ‘গ্রেট প্লেস অ্যাওয়ার্ড ২০২০’ প্রদান করে।
বাংলাদেশের মেগাপ্রজেক্টগুলোর মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র একটি। দেশের বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যেই প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণে মোট ব্যয় এক লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি টাকা (বাংলাদেশি মুদ্রায়)। কেন্দ্রটির নির্মাণকাজ, রক্ষণাবেক্ষণ, পারমাণবিক জ্বালানি গ্রহণ এবং প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি ব্রিগেড, যা বাংলাদেশের মানুষের কাছে দেশের সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে।
দেশে প্রথম পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল পরিবহনের কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে দুই হাজার ৮৬১ কোটি ৩১ লাখ টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত পাইপলাইনে জ্বালানি তেল পরিবহনের কাজ চলমান রয়েছে। এই প্রকল্পের কাজ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। পাইপলাইন স্থাপনের পর বছরে ২৭ থেকে ৩০ লাখ টন জ্বালানি তেল পরিবহন করা সম্ভব হবে, যা পর্যায়ক্রমে ৫০ লাখ টন পর্যন্ত বাড়ানো যাবে। এই প্রজেক্ট সফল হলে জ্বালানি তেলের দাম কমার সম্ভাবনা রয়েছে। এই প্রকল্পের নির্মাণকাজের তত্ত্বাবধানে রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড।
দেশের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন অপরিহার্য। তারই ধারাবাহিকতায় ঢাকা শহরের অবকাঠামোগত উন্নয়নের লক্ষ্যে মিরপুর এয়ারপোর্ট রোডে ফ্লাইওভার, বনানী লেভেলক্রসিংয়ে ওভারপাস নির্মাণ, ৩০০ ফিট পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে, ১০০ ফিট খাল খনন প্রকল্প এবং ধানমণ্ডি লেক উন্নয়ন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত ১৮টি ওয়ার্ডের সড়ক অবকাঠামো ও জলাশয় নিষ্কাশনব্যবস্থার নির্মাণ ও উন্নয়ন প্রকল্প, ঢাকা জেলার দোহার উপজেলাধীন মাঝিরচর থেকে নারিশাবাজার হয়ে মোকসেদপুর পর্যন্ত পদ্মা নদী ড্রেজিং ও বাঁ তীর সংরক্ষণ প্রকল্প, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) এলাকার নিষ্কাশনব্যবস্থার উন্নয়নমূলক প্রকল্প, ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (লাইন-৫) : নর্দান রুটের এলিভেটেড ও আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনসমূহের ইউটিলিটি স্থানান্তরের কাজ ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট কম্পানি লিমিটেডের আওতায় বাস্তবায়নকারী ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (লাইন-১)-এর আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনসমূহের ইউটিলিটি স্থানান্তরের কাজ, রাজউক পূর্বাচল ৩০০ ফিট মহাসড়ক থেকে এভিনিউ সিলেট মহাসড়ক পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্প, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের রুট এলাইনমেন্টের মধ্যে অবস্থিত ইউটিলিটি শিফটিং এবং স্ট্রাকচার অপসারণ প্রকল্পগুলোর কাজ চলমান রয়েছে, যা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন করা হচ্ছে।
অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশে বিভিন্ন ব্রিজ, কালভার্ট, ওভারব্রিজ এবং বর্তমানে দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর উন্নয়নমূলক কাজ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। ঢাকা ও এর আশপাশের সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নে এবং যানজট নিরসনে হাতিরঝিল ইউলুপ, ঢাকা শহরের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের শিফটিংয়ের কাজ, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ চার লেন সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প। এ ছাড়া মহিপাল ফ্লাইওভারটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর নির্মাণের মাধ্যমে সহজে এবং স্বল্প সময়ে যাতায়াত নিশ্চিত করেছে। অত্যন্ত স্বল্প সময়ে মেঘনা-গোমতী ব্রিজের মেরামতকাজ সম্পন্ন করে সেনা সদস্যরা ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়ক সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
জাতিগঠনমূলক কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় মুক্তারপুর সেতু সংযোগ সড়কে পঞ্চবটি থেকে মুক্তারপুরে অবস্থিত দুটি সেতুর বিকল্প সড়ক নির্মাণ, সংস্কার এবং পুনর্নির্মাণকাজ সেনাবাহিনী সম্পন্ন করেছে। চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারটিও সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এমনকি পার্বত্য অঞ্চলে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উচ্চতা বিশিষ্ট সড়কসমূহ সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্মাণ করার কারণে পাহাড়ি জনপদে এসেছে উন্নয়ন এবং প্রাণের স্পন্দন। এ ছাড়া বর্তমানে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধায়নে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে সীমান্ত সড়ক নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে।
দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশ আজ বিশ্বে এক আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত অঞ্চলে আর্তমানবতার সেবায় জানমাল রক্ষা, ত্রাণ বিতরণ ও চিকিত্সাসেবা প্রদানে সেনাবাহিনী যে আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ায় তা দেশবাসীর কাছে প্রশংসিত। ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা দূরীকরণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। সেনা সদস্যরা দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে করে পর্যটনশিল্পের বিকাশসহ চট্টগ্রাম শহরের সার্বিক উন্নয়ন ঘটবে। একই বছর পাহাড়ধসে ক্ষতিগ্রস্তদের খাবার, পানি ও চিকিত্সাসেবা প্রদান করে জনগণের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করে জাতীয় পরিমণ্ডলে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম অনেক দেশের প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলা করে সেনা সদস্যরা বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছেন। ২০২৩ সালে তুরস্কে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের পর বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ সহায়তা প্রদান করাসহ সেনাবাহিনী থেকে একটি উদ্ধারকারী দল তুরস্কে গমন করে উদ্ধারকাজে সহায়তা প্রদান করেছে, যা বাংলাদেশ-তুরস্কের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরো দৃঢ় করেছে।
১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তির পর পাহাড়ে ফিরেছে স্থায়ী শান্তি। দেশের অখণ্ডতা রক্ষায় বদ্ধপরিকর সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী তত্পরতাকে রুখে দিয়েছে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা ‘অপারেশন উত্তরণে’র আওতায় মোতায়েন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য নানা ধরনের জনকল্যাণকর কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত থেকে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সহায়তা করেছে। এ ছাড়া কক্সবাজার বিচসংলগ্ন ৮০ কিলোমিটার কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ প্রকল্পটি ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্পসহ হাজারো প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্পেশাল ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন সম্পন্ন করেছে। যার ফলে সেনাবাহিনী জনগণের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করেছে।
দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে সবার হৃদয়ে স্থান করে নিয়ে দেশের ভাবমূর্তিকে আরো উজ্জ্বল করে তুলেছে সেনাবাহিনী। দেশের ক্রান্তিলগ্নে ‘অপারেশন থান্ডারলাইট’ ও ‘অপারেশন টুইলাইট’-এর মাধ্যমে জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে যেকোনো জাতীয় সমস্যা মোকাবেলায় সেনাবাহিনী আপামর জনসাধারণের আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে সারা দেশে দক্ষ এবং যোগ্য সামরিক কর্মকর্তা তৈরির জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ১২টি ক্যাডেট কলেজ পরিচালনা করে আসছে।
এ ছাড়া দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতিকল্পে দেশে ৪৪টি ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ১৯টি ইংলিশ ভার্সন এবং দেশের চিকিৎসা ক্ষেত্রে উন্নতির জন্য আর্মি মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরের উন্নতি এবং অবদানের জন্য এমআইএসটি এবং বিইউপির মতো দেশের অনেক নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার মাধ্যমে দেশে সুনাগরিক গড়ে তোলার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। সেনা পরিবার কল্যাণ সমিতির পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে প্রয়াস স্কুল প্রতিষ্ঠা একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ।
চিকিত্সাসেবার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে সিএমএইচ ঢাকা সম্প্রসারণ ও আধুনীকরণের ফলে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যসহ দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আধুনিক চিকিৎসাসেবা প্রদান সম্ভব হচ্ছে। দেশের চিকিৎসাক্ষেত্র প্রসারিত করার লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালে আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজ (এএফএমসি) এবং ২০১৪ সালে পাঁচটি সেনানিবাসে মেডিক্যাল কলেজ এবং আর্মি নার্সিং কলেজ (চট্টগ্রাম, বগুড়া, কুমিল্লা, যশোর ও রংপুর) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কভিড-১৯-এর মতো মহামারির প্রাক্কালে কভিডে আক্রান্ত রোগীর আইসোলেশনের ব্যবস্থা এবং দেশের জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে ইন এইড টু সিভিল পাওয়ারের আওতায় সহায়তা এবং দেশে আক্রান্ত কভিড রোগীর চিকিত্সায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিকিৎসকরা ছিলেন প্রথম সারির যোদ্ধা।
এ ছাড়া দেশের স্পোর্টস সেক্টরকে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কাজ করে যাচ্ছে। দেশের ফুটবলের উন্নয়নে আর্মি ফুটবল দল পরিচালনা, বক্সিং প্রতিযোগিতা, ভারোত্তোলন, দৌড় (১০০ মিটার স্প্রিন্ট এবং ৪০০ মিটার রিলে), অ্যাথলেটিকস, আর্চারিসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজনসহ বিদেশের মাটিতে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা স্বর্ণ, রৌপ্য, ব্রোঞ্জ পদকসহ সম্মানজনক স্থান অর্জন করে আসছে, যা সেনাবাহিনী এবং দেশের জন্য সম্মানের ও গর্বের।
দেশের মানুষের স্বার্থ রক্ষা এবং দেশের আপত্কালীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের এবং জাতির পরম বন্ধু। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সেতু নির্মাণ থেকে শুরু করে হাতিরঝিল, রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের মতো বিভিন্ন মেগাপ্রজেক্টসহ, আশ্রয়ণ, দারিদ্র্য বিমোচন ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় সেনাবাহিনী যেভাবে পেশাদারির সঙ্গে কাজ করে আসছে তা প্রসংশনীয়। বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুধু অভ্যন্তরীণ বিষয়েই নয়, বরং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাদের সর্বোচ্চ পেশাদারির পরিচয় দিয়ে দেশের সুনাম বৃদ্ধি করে চলেছে। যেখানেই মেগাপ্রজেক্ট সেখানেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি নির্ভরতার নাম। দেশ ও জাতির যেকোনো ক্রান্তিকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ পেশাদারির পরিচয় দিয়ে সদা সর্বত্র দেশ ও জনগণের পাশে থেকেছে পরম বন্ধু হিসেবে। কর্মস্পৃহা ও পেশাদারিতে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ একটি অপরিহার্য নাম। অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও দেশের দুর্যোগকালীন দেশের ও দেশের মানুষের পাশে থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বহু দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছে। জাতির গর্বে গর্বিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাই আজ জাতির আস্থার প্রতীক।