এরিস্টটলের বিখ্যাত একটা উক্তি আছে, “Man is social and political by nature ” মানুষ স্বভাবতই সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব। এরিস্টটলের এই বিখ্যাত কথাটা আমাদের বঙ্গদেশেও প্রযোজ্য। রাজনীতি যেন আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মূলত আমাদের দেশে রাজনীতি মানুষের জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রাজনীতি হয় রাজনৈতিক দলের, রাজনীতি হয় ব্যক্তির,রাজনীতি হয় ব্যবসায়ীর,ডাক্তার,ইন্জিনিয়ার,স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে সকল পেশাজীবীর মানুষের মধ্যে।
রাজনীতি মূলত একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার তীব্র সুপ্ত বাসনা। একজন ব্যবসায়ী তার রাজনৈতিক কূটকৌশল প্রয়োগ করে চাইবে অন্য ব্যবসায়ীকে কুপোকাত করে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করতে। একজন ডাক্তার চাইবে তার প্রজ্ঞা ও মেধা, সক্ষমতা দিয়ে অন্য ডাক্তার থেকে নিজের খ্যাতি,সুনাম বাড়াতে। এভাবে সমাজের সকল স্তরের মানুষই চায় অন্যকে ছাড়িয়ে নিজের অবস্থান কে পাকাপোক্ত করতে।প্রকৃতপক্ষে এগুলো সবই রাজনীতির অংশ। তাই এরিস্টটল যথার্থই বলেছেন মানুষ স্বভাবতই সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব।
কিন্তু আজ আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু মানুষের পেশা সম্পর্কিত রাজনীতি নয়। আজ আমরা আলোচনা করতে চাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলসমূহের মফস্বল এলাকার তৃণমূল রাজনীতির সমসাময়িক ঘটনাবলি নিয়ে। একটা রাজনৈতিক দলের প্রাণই হচ্ছে তৃণমূল। অতএব তৃনমূলকে জানা,তৃণমূলের রাজনীতির সুস্পষ্ট ধারনা রাজনৈতিক দলসমূহের জন্য অত্যন্ত আবশ্যকীয় ও গুরুত্বপূর্ণ । তাই আজ আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু তৃনমূলের রাজনীতি।
আমরা সকলেই জানি ৫ই আগষ্টে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার ডাকে এদেশের আপামর জনসাধরনের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে ও প্রায় ২ হাজার ছাত্র-জনতার প্রানের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এক নতুন স্বাধীনতা। কুশীলবরা একে বলে থাকেন বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা নামে। ফলে ৫ই আগষ্টের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখা দিয়েছে এক নতুন বাস্তবতা। জনমনে আশা আকাঙ্ক্ষার নানা ফুলঝরিও লক্ষ্য করা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। নতুন রাজনৈতিক দল গঠন হয়েছে। নতুন-পুরাতন সকল রাজনৈতিক দলসমূহের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে এদেশের জনগনের আশা ও প্রত্যাশার নতুন জয়গান। বাংলাদেশকে ঢেলে সাজানোর প্রয়াশে তারা বিভিন্ন মিশন,ভিশন ও প্রকাশ করে যাচ্ছে অনবরত। এই যেমন বিএনপির ৩১ দফা। এছারাও জামায়াত,এনসিপি সহ ডান-বাম সকল রাজনৈতিক দলের স্বতন্ত্র নানারকম এজেন্ডা সামনে আসছে ধারাবাহিকভাবে ।
কিন্তু এতদাসত্বেও রাজনৈতিক দলসমূহের মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা ও তাদের নানারকম প্রতিশ্রুতির অফিসিয়ালি বক্তব্যের মাঝে লক্ষ্য করা যাচ্ছে বিরাট তফাৎ। যা নতুন বাংলাদেশ গঠনে কতটুকু সহায়ক ভূমিকা পালন করবে তা নিয়ে দেখা যাচ্ছে অনিশ্চয়তা।
আমরা মফস্বলের তৃনমূলের দিকে তাকালে প্রায়ই দেখতে পাই তাদের মধ্যে দেখা যায় এক অস্থিরতা, উৎকন্ঠা। বিভিন্ন চাঁদা বাজি থেকে শুরু করে বিগত সরকারের ফেলে যাওয়া অবৈধ টাকা রোজগারের ফাঁকা আসনগুলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসমূহের নেতাকর্মী দ্বারা পূরন হচ্ছে যা নতুন বাংলাদেশ গঠনের অন্তরায়। ৫ ই আগস্টে এত এত প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এই নতুন স্বাধীনতায় পুরনো সময়ের পতিত সরকারের সকল কার্যক্রম যদি পুনরায় সচল হয় তাহলে জাতী হিসেবে সেটি হবে লজ্জার। অনেক সময় শালিশ বিচারের নাম করে একটা নির্দিষ্ট পক্ষের টাকা খেয়ে করা হয় প্রহসন। স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের নামে থানায় মামলা করে প্রতিনিয়ত করা হচ্ছে মামলা বানিজ্য। আবার কারো কারো বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাৎ করে আওয়ামী পুনর্বাসন এর সুনির্দিষ্ট অভিযোগও পাওয়া যায়। আবার এই সুযোগে ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার অভিযোগও রয়েছে কারো কারো বিরুদ্ধে। গোয়ালের গরু ছিনিয়ে নেওয়া থেকে শুরু করে পুকুরের মাছ জোরপূর্বক দখল করা,অবৈধ কাজে অন্যায়কারীদের সঙ্গে আঁতাত করে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া এখন তৃনমূলের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে দেখা দিচ্ছে। আইন, প্রশাসন ও অনেকটা স্থবির। তাদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে নানারকম অনীহা ও উৎকন্ঠা। ৫ই আগষ্টের ধকল থেকে পুলিশ বাহীনির মনোবল ফিরে পাওয়ায় দেখা যাচ্ছে মন্থরতা। অনেকটাই মাৎসন্যায়ের পুনরাবৃত্তি। ক্ষমতাবানরা ক্ষমতাহীনদের উপর খড়গহস্ত। এমন অভিযোগও শোনা যায় সাধারন মানুষদের মামলা হামলা করে উপভোগ করা হচ্ছে একপ্রকার পৈশাচিক আনন্দ।
এগুলোর অবসান হওয়া এখন সময়ের দাবী। আর এর থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হচ্ছে রাজনৈতিক দলসমূহের সদিচ্ছা। রাজনৈতিক দলসমূহের সদিচ্ছার অভাবেও অনেক সময় এমন অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হয়। এমতাবস্থায় তৃনমূলের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা রাজনৈতিক দলসমূহের আবশ্যকীয় দায়িত্বে পরিনত হয়েছে। দলীয় সাংগঠনিকতা বৃদ্ধি ও শৃঙ্খলা পরিপন্থী কর্মকান্ডের সুনির্দিষ্ট উপায়ে বিচারের মুখোমুখি করা ও আইনের সুশাসন যখন প্রকৃতপক্ষে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে ও মাঠপর্যায়ে যখন বাস্তবায়ন হবে তবেই কেবল সম্ভব এসব নৈরাজ্য থেকে মুক্তি পাওয়া। যা নতুন বাংলাদেশে জনগনের নিকট রাজনৈতিক দলসমূহ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
নাজমুল সরদার
সরকারী রাজেন্দ্র কলেজ,ফরিদপুর
অর্থনীতি (বি.এস.এস)